ইব্রাহীম মিঞা, বিরামপুর (দিনাজপুর) প্রতিনিধি :অটো চার্জার ভ্যানের সামনে ছোট মাইক লাগিয়ে গানের সুর ও ছন্দে নিজের উৎপাদিত কুটির শিল্পপণ্য বিক্রি করছেন মাহালি মাইকেল মার্ডি। অটো চার্জার ভ্যান বোঝাই নিজের হাতের তৈরি বাঁশের বিভিন্ন ধরনের প্রয়োজনীয় জিনিস সমূহ নিয়ে সে ছুটে চলেছে উপজেলার এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে বাজারজাতকরণের উদ্দেশ্যে।
নিজের উৎপাদিত কুটির শিল্পপণ্য বিক্রিরত অবস্থায় তাঁকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় দিনাজপুরের বিরামপুর পৌরশহরের ৪ নং ওয়ার্ডের ইসলামপাড়া এলাকায়।সে পৌরশহরের ৭ নং ওয়ার্ডের চাঁদপুর মাহালিপাড়ার জোসেফ মার্ডির ছেলে মাইকেল মার্ডি (৪০)। দুই মেয়ে ও এক ছেলে সন্তানসহ স্ত্রীকে নিয়ে তাঁর বসবাস। তাঁর বাবা ও মা বর্তমানে সরকারের দেওয়া ঘরে খাঁনপুর ইউনিয়নের গুচ্ছ গ্রামে বাস করেন।বড় মেয়ের বিয়ে দিলেও সংসারে বোঝা টানতে গিয়ে ছোট মেয়ে মেঘনা মার্ডি ও ছেলে সাগর মার্ডির পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি তাঁর। সারাদিন ছেলে সন্তান ও স্ত্রীর হাতের তৈরি বাঁশের বিভিন্ন জিনিসপত্র বাজারজাতকরণে ভ্যান নিয়ে ছুটে চলেন মাইকেল মার্ডি।
তাঁর সাথে কথা বলে জানাযায়, একটি বাঁশের মূল্য ২৫০ থেকে ৩০০ টাকায় ক্রয় করে ১ দিনে ২ টি খাঁচা তৈরি করেন। পরবর্তীতে ২ টি খাঁচা ৪০০ থেকে ৫০০টাকায় বিক্রি করে আয় হয় তাঁর ২০০ থেকে ২৫০টাকা। এই টাকাকে ২ দিনের মজুরি হিসেবে ভাগ করলে পরে ১০০ থেকে ১২৫টাকা। আমরা ২ জন মানুষ পরিশ্রম করে দুইশত থেকে ২৫০ টাকা দিয়ে সংসার খরচ চালানো সম্ভব হয়না, আমরা পারি না। সরকার যদি আমাদের দিকে দেখতো,একটু সুযোগ সুবিধা দিতো তাহলে ছেলে মেয়ে নিয়ে সংসার খরচ চালানো একটু সহজ হতো।
মাইকেল মার্ডি তাঁর অটো চার্জার ভ্যানে স্ত্রী, সন্তান ও নিজের হাতের তৈরি বাঁশের বিভিন্ন জিনিসপত্র সাজিয়ে গুছিয়ে নিয়ে প্রতিদিন সকালে বাড়ি থেকে বাহির হন।দিন শেষে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরেন । বছরের ধান কাটা মৌসুমে গ্রামের অলিগলিতে ঘুরে ঘুরে তাঁর বেচাকেনা ভালো হয়। কিন্তু এই উপার্জন দিয়ে সংসারের সদস্যদের মুখে হাসি ফোটাতে পারেনি কখনো। তিনি জানান,অন্য কোন কাজকর্ম জানিনা। বাপদাদার ও জাতিগোষ্ঠীর আদি পেশা হিসেবে এই কর্ম ছাড়া কোন কিছুই করতে পারি না তাই কষ্ট হলেও এই পেশা ধরে রেখেছি।
তাঁর অটো চার্জার ভ্যানে রয়েছে বাঁশের তৈরি কবুতরের ঘর, বাঁশের তৈরি ঝাড়ু, বিয়ের ডালা, রঙিন কূলা, মুরগি রাখা খাঁচা, মুরগি রাখা ঝাপা,রুটির ডালা,আটা রাখার ধামা,ভাত ঢালা ধামা,খৈ চালা,বারুন,সরপেশের ঢাকনা,ডালি,পানের ডালা ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের নিজের হাতে বাঁশের তৈরি কুটির শিল্প। এগুলো আগে উপজেলার বিভিন্ন হাটবাজারে বসে বিক্রি করতেন। বর্তমানে প্লাস্টিকের ব্যবহার বেশি হওয়ায় হাট বাজারে বসে তেমন বেচাকেনা হয় না। দিন দিন এর চাহিদা কমে যাচ্ছে।
অটো চার্জার ভ্যানে করে বিক্রি করার কারণ জানতে চাইলে মাইকেল মার্ডি জানান,দিন দিন বাঁশের তৈরি কুটির শিল্পপণ্যের চাহিদা কমে যাওয়ায় হাট বাজারে তেমন বেচাকেনা আর হয়না। অটো চার্জার ভ্যানে করে অল্প সময়ে উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে ও গ্রামের অলিগলিতে কুটির শিল্পপণ্যের বাজারজাতকরণের পাশাপাশি এর বিক্রি বেড়েছে। এতে করে অল্প সময়ে বেচাকেনা বেশি হয়ে থাকে। তিনি জানান,কষ্ট করে কিস্তি ও প্রতিবেশীর সহযোগিতায় এই অটো চার্জার ভ্যান কিনেছেন তিনি
তিনি বলেন উপজেলায় আমাদের মতো প্রায় ৫০ টি পরিবার রয়েছে। সরকার যদি আমাদের এ পেশার মানুষের জীবন মানোন্নয়নের লক্ষ্যে কোন প্রকল্পের আওতায় আমাদের উৎপাদিত পণ্য এবং পেশার আধুনিকায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেন তবেই আমাদের জীবন মানোন্নয়ন সম্ভব।
এবিষয়ে মুঠোফোনে বিরামপুর উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা আব্দুল আউয়াল এর সাথে কথা বললে তিনি বলেন, সরকার বাংলাদেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নের লক্ষ্যে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে তাঁদের অর্থনৈতিক সাংস্কৃতিক ও সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধিসহ সমাজের মূল শ্রোতধারায় সম্পৃক্তকরণের নিমিত্ত কাজ করে যাচ্ছে। এরকম প্রকল্পের আওতায় এই উপজেলায় বসবাসরত মাহালি পরিবারসহ প্রান্তিক পেশাজীবী জাতিগোষ্ঠীর দক্ষতা উন্নয়নের মাধ্যমে উৎপাদিত পণ্য ও সেবার উৎকর্ষ এবং পেশার আধুনিকায়নের মাধ্যমে তাঁদের জীবনমান উন্নয়ন করা যেতে পারে।