ইব্রাহীম মিঞা, বিরামপুর (দিনাজপুর) প্রতিনিধি : দিনাজপুরের বিরামপুরে প্রতিবছর বৈশাখ মাসের প্রতি বৃহস্পতিবার এই চুনের মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে পৌরসভার ১ নং ওয়ার্ডের দেবীপুর ও খানপুর ইউনিয়নের পান্নাথপুরে।
বৈশাখ মাসে কোন বছর ৪ বৃহস্পতিবার আবার কোন বছর ৫ বৃহস্পতিবার পরে এভাবে বৈশাখ মাসের প্রত্যেক বৃহস্পতিবার দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে এই মেলায় প্রায় ২ সহস্রাধিক মানুষ উপস্থিত হন। এক শতাব্দীর বেশি সময় ধরে জঙ্গলের মাঝে এই মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে বলে জানিয়েছেন মেলা পরিচালনা কমিটির সদস্য শহীদুল ইসলাম।
বৃহস্পতিবার (২৪ এপ্রিল) ১১ বৈশাখ বিকেল সাড়ে ৪ ঘটিকায় চুনের মেলায় গিয়ে দেখা যায় মেলার দোকান গুলোতে কেনাকাটা জমে উঠেছে।
স্থানীয়রা জানান বিরামপুর পৌরসভার চুরকুই (চরকাই) গ্রামে আজ থেকে প্রায় ২৫০ বছর আগে আনসার আলী দেওয়ান শাহ নামে একজন ফকির( কবিরাজ ) ছিলেন। তিনি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে দ্বীনের দাওয়াত দিয়ে বেড়াতেন ।তার পরিচিতি ছিল অনেক। এই সুবাধে তৎকালীন চুরকুই গ্রামে চক্রবর্তী রাজা যার বাড়ির ধ্বংসাবশেষ এখনো কিছু রয়েছে চুরকুই গ্রামে। তার নিকট থেকে বর্তমানে খাঁনপুর ইউনিয়নের পান্নাথপুর গ্রামের জঙ্গলে জমির ম্যাপের উপর একটি রুমাল পরিমাণ জমি সে চেয়ে নেন,যার পরিমাণ ছিল প্রায় ১ একর ৪৪ শতাংশ।এই জমিতে আনসার আলী দেওয়ান শাহ একজন মিস্ত্রী দিয়ে তার কবর খুঁড়ে নেন পরবর্তীতে ঐ কবরে বৃহস্পতিবার দিনে আসরের পর একটা ঘটি(বদনা), একটা লাঠি,একছরি কলা ও খরম(স্যান্ডেল জাতীয়)পায়ে তিনি জীবিত প্রবেশ করেন এবং তিনি মিস্ত্রী কে বলেন আমার কবরটি মাটি দিয়ে ঢেকে দিতে।এরপর থেকে তিনি আর সেখান থেকে ফিরে আসেননি। তার জিন্দা কবরে প্রবেশ করায় একসময় তার এই কবরটি জিন্দা বাবার মাজার হিসেবে অনেক জায়গায় পরিচিতি লাভ করে এমনটি জানিয়েছেন মোঃ শাকিল হোসেন,সে বংশপরম্পরায় আনসার আলী দেওয়ান শাহ এর নাতি। তার দাদার দাদার দাদা প্রায় ৩ পিরি বংশপরম্পরায় চালিয়ে আসছেন এইদিনে তার কবর জিয়ারত।
এই মাজার (কবর)টিকে কেন্দ্র করে বৈশাখ মাসের প্রত্যেক বৃহস্পতিবার তার বংশধর ও ভক্তরা তার কবর জিয়ারতে আসতেন সে সময় মাজারের (কবরের) সৌন্দর্য বৃদ্ধির লক্ষ্যে মৃত আনসার আলী দেওয়ান শাহের প্রিয় রং ছিল সাদা সে কারনে তার মাজার (কবর)চুন দিয়ে লেপে দেওয়া হতো এবং আগত দর্শনার্থীদের খাজা,বাতাসা তবারক হিসেবে তাদের মাঝে বিতরণ করা হতো।
এভাবে বৈশাখ মাসের প্রত্যেক বৃহস্পতিবার ঐ মাজারের (কবরের) পাশে বসতো বেশকয়েকটি চুনের দোকান ও খাজা, বাতাসার দোকান তা পর্যায়ক্রমে মেলায় রুপ ধারণ করে এবং চুনের মেলা হিসেবে পরিচিত লাভ করে বলে জানিয়েছেন ৪০ বছরের বেশি সময় ধরে বংশপরম্পরায় এই মেলায় চুন বিক্রেতা শ্রী সুনিল সরকার।
এই চুনের মেলায় বিভিন্ন প্রকার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র,খাবার, খেলনা, কসমেটিক, হিন্দু সম্প্রদায়ের জন্য হাতের সাখা,সীথির সিদূর এবং মিষ্টি আলুসহ হরেকরকম জিনিসপত্রের ৭০-৮০ টি দোকান দেখা যায়।
বিরামপুর পৌরসভার ১ নং ওয়ার্ডের চরকাই (চুরকুই) গ্রামের প্রায় ১০০ বছরের বৃদ্ধা মোছাঃ সালেমা বেগম তার ছেলে ইয়াদ আলী এবং নাতি নাতনিকে নিয়ে এসেছে এই চুনের মেলায়। তিনি জানান আমার বিয়ের পর থেকেই আমি এই বৈশাখ মাসের বৃহস্পতিবার দিনে মেলায় আসি এবং আসতে আমাকে ভালো লাগে।
বিরামপুর পৌরসভার চরকাই (চুরকুই) গ্রামের মৃত আনসার আলী দেওয়ান শাহের বংশের শাকিল হোসেন পিতা মোজাফফর হোসেন জানান আমরা প্রতি বছর এই সময়ে আমার দাদা মোকছার হোসেন মারা যাওয়ার পর থেকে আমি ও আমার (দাদির বোন)দাদি মেহেরজান (৭৯) মাজারের (কবরের) জিয়ারতে আসা দর্শনার্থীদের দেওয়া চুনগুলো লেপে দেওয়া এবং খাজা, বাতাসা গুলো সকলের মাঝে বিতরণ করি।
এই চুনের মেলায় বাপ দাদার সাথে আসা এবং বাপদাদার বংশপরম্পরায় মেলায় দোকান দিয়ে আসছেন পৌরসভার ভেটাই গ্রামের জগদীশ বাবু (চুন বিক্রেতা),শুনিল সরকার (চুন বিক্রেতা) বাতাসা ও খাজা বিক্রেতা কাকাতো দুই ভাই সুকেন ও শাধন। এছাড়াও এবার বিরামপুর পৌরসভার ৪ নং ওয়ার্ডের ইসলাম পাড়া গ্রামের ছোটকা চাচা দিয়েছেন লাটাইসহ রং বেরঙের ঘুড়ির দোকান। মেলায় দোকান নিয়ে আসা দোকানদারদের নিকট মেলা কতক্ষন সময় ধরে থাকে এবিষয়ে জানতে চাইলে তাঁহারা বলেন, দুপুর ৩ থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত।
এই মেলার বিষয়ে জানতে চাইলে বিরামপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মমতাজুল হক জানান চুনের মেলার বিষয়ে মেলা পরিচালনা কমিটির পক্ষ থেকে কিছু জানানো হয়নি।