রায়হান চৌধুরী রকি, পঞ্চগড় প্রতিনিধি : নিজেদের নৈতিকতার মান উন্নয়ন, দেশ সেবা এবং মানবতার কল্যাণে কাজ করার ব্রত নিয়ে বৃহস্পতিবার শেষ হলো আহমদীয়া মুসলিম জামাতের ৯৯ তম সালানা জলসা বা বার্ষিক সন্মেলন। পঞ্চগড় শহরের উপকণ্ঠে আহমদনগরে নিজস্ব দেয়াল ঘেরা মাঠে অনুষ্ঠিত এই সন্মেলনে সারাদেশ থেকে প্রতিনিধিগণ যোগদান করেন।
১৩ ফেব্রুয়ারি সকাল পৌণে দশটায় পতাকা উত্তোলন, জাতীয় সংগীত পরিবেশনা এবং দোয়ার মাধ্যমে জলসার কার্যক্রম শুরু হয়। জলসার উদ্বোধনী ভাষনে আহমদীয়া মুসলিম জামাতে, বাংলাদেশ এর ন্যাশন্যাল আমীর মাওলানা আব্দুল আউয়াল খান চৌধুরী বলেন, আমাদের জলসা কোন সাধারণ সন্মেলন নয়, এটি একটি আধ্যাত্মিক সমাবেশ যেখানে আমাদের সদস্যগণ তিন দিন অবস্থান করে বাজামাত নামায তাহাজ্জুদ এবং ওয়াক্তিয়া নামাযগুলো আদায় করার পাশাপাশি ধর্মীয় এবং আধ্যাত্মিক বিষয়ে জ্ঞান লাভ করে থাকেন। পবিত্র কোরআন এবং মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর অনুপম শিক্ষা এবং নির্দেশনার আলোকে নিজেদের জীবনকে গড়ে তোলার পথনির্দেশনা পেয়ে থাকেন। আমাদের সদস্যরা বছরের একটি দিনের জন্য সারা বছরব্যাপী অপেক্ষায় থাকেন। আমাদের জলসা সম্প্রীতি ও ভ্রাতৃত্ববোধের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
বিগত বছরের বিয়োগান্ত দুঃখজনক ঘটনার উল্লেখ করে ন্যাশন্যাল আমীর বলেন, বিরোধিতা সত্য জামাতের একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য। আহমদীয়া মুসলিম জামাতের বিগত একশ’পঁয়ত্রিশ বছরের ইতিহাস এ স্বাক্ষ্য বহন করে যে, বিরোধিতা এবং অত্যাচার আমাদের কোন ক্ষতি করতে পারে নি বরং আল্লাহতালার অসীম সাহায্য এবং কল্যাণে দিন দিন এই জামাত বৃদ্ধি প্রাপ্ত হচ্ছে এবং সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ছে। বর্তমানে বিশ্বের ২২০ টি দেশে এই জামাত সুপ্রতিষ্ঠিত।
তিন দিনের জলসার ৫ টি অধিবেশনে বিভিন্ন বক্তাগণ আল্লাহতালার অস্তিত্ব, দোয়ার গুরুত্ব ও কবুলিয়ত, মহানবী (সাঃ) এবং পবিত্র কুরআনের এর অতুলনীয় শান ও মর্যাদা, মানব সেবা, দেশপ্রেম, পারিবারিক ও সামাজিক কল্যাণ, আর্থিক কুরবানী, বিশ্বশান্তি, সামাজিক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি বিষয়ে জ্ঞানগর্ভ বক্তব্য প্রদান করেন।
জলসায় গত বছর উগ্র ধর্মান্ধদের আক্রমণে শাহাদাত বরনকারী শহীদ প্রকৌশলী জাহিদ হাসানের পিতা আবু বকর সিদ্দিক সন্তানের স্মৃতিচারণ করে বক্তব্য প্রদান করেন।
এবার শান্তিপূর্ণ পরিবেশে জলসা অনুষ্ঠানের বিষয়ে যথাযথ উদ্যোগ এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আহমদীয়া মুসলিম জামাত সরকার ও প্রশাসনকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছে। তবে আগামীতে সুস্থ ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে এবং নানা মত ও পথের অনুসারীদের পরমতসহিষ্ণু ও সম্প্রীতিময় সহাবস্থানের মাধ্যমে জলসা অনুষ্ঠানসহ প্রত্যেক নাগরিকের নিজ নিজ ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালন করার বিষয়ে পরিবেশ সৃষ্টির প্রতি বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করা হচ্ছে।
স্বল্প সময়ের প্রস্তুতি এবং কর্মদিবসে জলসা অনুষ্ঠিত হওয়ায় এবারের উপস্থিতি নিয়ে শঙ্কা ছিলো, তথাপি আমাদের সদস্যগণ প্রতিকূল পরিস্থিতি উপেক্ষা করে বিপুল সংখ্যায় অংশ গ্রহণ করেন, আলহামদুলিল্লাহ। ন্যাশন্যাল আমীর ১৫ ফেব্রুয়ারি ফজর নামাযের পর সমাপ্তি ভাষণ ও সম্মিলিত দোয়ার মাধ্যমে জলসার কার্যক্রমের সমাপ্তি ঘোষণা করেন। দেশের অব্যাহত উন্নতি ও কল্যাণ, ফিলিস্তিনের নির্যাতিত মুসলমানদের শান্তি ও নিরাপত্তা, যুদ্ধ আক্রান্ত বিভিন্ন দেশসহ সারা বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য পরম করুণাময় আল্লাহর দরবারে দোয়া করা হয়। তাহাজ্জুদের নামাযের সময় কানায় কানায় পরিপূর্ণ জলসা মার্কীতে এক অভূতপূর্ব আধ্যাত্মিক পরিবেশের সৃষ্টি হয়।
সালানা জলসাকে কেন্দ্র করে এবার প্রশাসন নজিরবিহীন নিরাপত্তায় ব্যবস্থা গ্রহণ করে। সর্বত্র সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। শহরের মোড়ে মোড়ে, জলসাস্থলের আশেপাশে প্রচুর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের মোতায়েন করা হয়েছে। সাইরেন বাজিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গাড়িবহর টহল দিতে দেখা যায়। পঞ্চগড় শহর আহমদনগর জলসা স্থলের আশপাশের এলাকা ছিল পুরো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। সারা দেশ থেকে আসা পুলিশের ৪ হাজার সদস্য দায়িত্ব পালন করছে। এর বাইরে বিজিবি ১৬ প্লাটুন, র্যাবের ১৬ টি টিমসহ অন্যান্য আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা দায়িত্ব পালন করে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের অবস্থানের জন্য পৌর ও বোদা উপজেলার ২৬ টি প্রতিষ্ঠানের ১১ থেকে ১৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত পাঁচদিন শ্রেণি পাঠদান বন্ধ ঘোষণা করা হয়।
গত কয়েক বছর ধরেই আহমদিয়া সম্প্রদায়ের জলসা বন্ধ ও তাদের রাষ্ট্রীয়ভাবে অমুসলিম ঘোষণার দাবিতে আন্দোলন করে আসছিল ইসলাম ধর্মীয় কয়েকটি সংগঠন। গত বছরের ২ থেকে ৪ মার্চ আহমদিয়া সম্প্রদায়ের উপর হামলা, তাদের শতাধিক দোকানপাট, ঘরবাড়িতে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। সংঘর্ষে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, সাংবাদিকসহ অর্ধশতাধিক আহমদিয়া সম্প্রদায়ের মানুষ আহত। ওই ঘটনায় আহমদিয়া সম্প্রদায়ের একজনসহ ২ জন নিহত হয়। ঘটনার পর ত্রিশেরও অধিক মামলা হয়েছে। এসব মামলায় নামসহ অজ্ঞাতনামা ১৫ হাজার জনকে আসামী করা হয়েছে। এসব মামলা পুলিশ, র্যাব ও ভিকটিমরা দায়ের করে। এবারও জলসা বন্ধের দাবিতে গত ২৮ জানুয়ারি সম্মিলিত খতমে নবুওয়ত সংরক্ষণ পরিষদ জেলা প্রশাসক বরাবরে স্মারকলিপি দিয়েছে। শুক্রবার ঢাকার বাইতুল মোকাররম মসজিদের সামনে বিক্ষোভ করে ইসলাম ধর্মীয় সংগঠনের নেতাকর্মীরা জলসা বন্ধের দাবিতে রোড মার্চের হুশিয়ারি দেয়।
সালানা জলসা অফিসার ও আহমদীয়া জামাতের বহিঃসম্পর্ক, গণসংযোগ, প্রেস ও মিডিয়া বিভাগের পরিচালক আহমদ তবশির চৌধুরী প্রশাসনকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, আমরা শান্তিপূর্ণ পরিবেশে আমাদের ধর্মকর্ম পালন করতে চাই। গতবছর জলসাকে কেন্দ্র করে আমাদের সম্প্রদায়ের নামে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে সাধারণ মানুষকে উত্তেজিত করে আমাদের সম্প্রদায়ের শতাধিক দোকানপাট, বাড়িঘরে হামলা চালিয়ে লুটপাট করে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটিয়েছ। এতে আমাদের সম্প্রদায়ের একজনকে পিটিয়ে মেরেছে। জলসার লক্ষ্য ও মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে আমাদের জামাতের সদস্যগণ যেন এভাবে বার বার পরস্পর সাক্ষাতের মাধ্যমে নিজেদের মাঝে এমন এক পবিত্র পরিবর্তন সাধন করে যাতে তাদের হৃদয় সম্পূর্ণরূপে পরকালের দিকে ঝুঁকে যায়। আর তাদের ধর্মভীরুতা, তাকওয়া, খোদাভীতি, পরহেযগারী, সহানুভূতি, পারস্পরিক ভালবাসা ও ভ্রার্তৃত্ববোধে তারা যেন অন্যদের জন্য একটা আদর্শে পরিণত হয়। নম্রতা, বিনয় ও সততা যেন তাদের মাঝে সৃষ্টি হয়। আর ধর্মীয় উৎকর্ষের জন্য তারা যেন পরিশ্রমের রাস্তা বেছে নেয়”।