Type Here to Get Search Results !

জীবনের শেষ মুহূর্তে পাওয়া টাকা পরিশোধ

প্রতিদিন আমার ফার্মেসীতে একটা মেয়ে কাষ্টমার আসে। তখন রাত বেজে যায় প্রায় বারোটার মতো। আজকেও তার বিপরীত হলো না। বারোটা বাজার পাঁচ মিনিট আগেই সে আসলো। এসে কিছু ঔষধ নিলো। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম- 'আপু, আপনি একজন মেয়ে হয়ে এতো রাতে কেন আসেন ফার্মেসীতে ওষুধ কিনতে? বাসায় কি কোনো পুরুষ মানুষ নেই?'

'আসলে ভাইয়া, আমি একটা দোকানে টেইলারিংয়ের কাজ করি যেটা এখান থেকে প্রায় পাঁচ কিলো দূরে। তাই আসতে আসতে দেরি হয়ে যায়। আর বাসায় আমি ছাড়া আর কেউ নেই ওষুধ কিনে নিয়ে যাওয়ার মতো। আম্মু আছে কিন্তু সে অসুস্থ। আর ওষুধ গুলোও আম্মুর জন্যই নেই প্রতিদিন।'

'ওহ আচ্ছা, তাহলে একবারে সব ঔষধগুলো কিনে নিয়ে যান। তাহলে আপনার সুবিধা হতো আর কি।'

'মাস শেষে যেই টাকা বেতন পাই সেটা ঘর ভাড়া আর খাবার খরচেই শেষ হয়ে যায়। তাই একসাথে ঔষধগুলো কিনতে পারি না। প্রতিদিন আমাকে নাস্তা আর যাওয়া আসার গাড়ি ভাড়ার জন্য যেই টাকা দেয় সেটা বাঁচিয়ে আম্মুর জন্য ঔষধ কিনে নিয়ে যাই।'

মেয়েটার কথাগুলো বুকে এসে বিঁধলো। একটা মেয়ে কতটা অসহায় হলে প্রতিদিন পাঁচ কিলো পাঁচ কিলো মোট দশ কিলো হাঁটতে পারে! তাকে কিছু বলে সান্ত্বনাও দিতে পারলামনা। সান্ত্বনা দেয়ার মতো কোনো শব্দও মুখে উচ্চারণ হচ্ছে না আমার। এমনও কাষ্টমার আসে আমার দোকানে যাদের ঔষধের কোনো প্রয়োজনই নেই তবুও শুধু শুধু ঔষধ কিনে নিয়ে যায় যদি পরে প্রয়োজন পড়ে সেজন্য। আমি তাকে বললাম, 

'অনেক রাত হয়েছে সাবধানে যাবেন। আর কোনো ঔষধ লাগলে আমার দোকান থেকে নিতে পারেন টাকা পরে দিলেও হবে।'

'আচ্ছা, ঠিক আছে ভাইয়া। দোয়া করবেন, আসি। একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে চলে গেলো। 

আজ সকালে একটু দেরি করে দোকান খুললাম। শরীরটা তেমন ভালো না। দোকান খুলে মাত্র বসেছি হঠাৎ করে সেই মেয়েটা এসে বললো,

'আপনার জন্য প্রায় অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছি ভাইয়া। এতো দেরি করে কেউ দোকান খুলে?'

'আমি তার দিকে তাকিয়ে একটা মুচকি হাসি দিয়ে বললাম, 

'আসলে, শরীরটা একটু খারাপ তাই ঘুম থেকে উঠতে লেট হয়ে গেছে। সরি, আপনাকে অপেক্ষা করতে হয়েছে আমার জন্য।'

'না না, সমস্যা নেই ভাইয়া। আপনি নিজের শরীরের যত্ন নিবেন, আর আমাকে একটা হেল্প করুন ভাইয়া।

'জি বলুন, চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ।'

'আসলে, আম্মুর শরীরটা ভালো নেই তাই আজ হাফটাইমের জন্য কাজে যেতে পারিনি। আমার কাছে টাকাও নেই। আপনি যদি একটু এই ওষুধগুলো দিতেন ভালো হতো। আমি দুপুরের পরে দোকানে যাবো রাতে ফিরে আপনাকে টাকা দিবো আসলে, আম্মুর শরীরটা ভালো নেই তাই আজ হাফটাইমের জন্য কাজে যেতে পারিনি। আমার কাছে টাকাও নেই। আপনি যদি একটু এই ওষুধগুলো দিতেন ভালো হতো। আমি দুপুরের পরে দোকানে যাবো রাতে ফিরে আপনাকে টাকা দিয়ে দেবো।'

'সমস্যা নেই, আপনি পরে দিলেও চলবে। কী ঔষধ দেবো বলুন?'

'এই যে প্রেসক্রিপশন, এখানে লেখা আছে।'

তারপর তাকে কিছু ঔষধ দিয়ে দিলাম। সে একটা ধন্যবাদ দিয়ে চলে গেলো। আমিও ব্যাস্ত হয়ে গেলাম দোকানে।

রাতের প্রায় এগারোটার মতো বাজে। কিছু লোক আসলো আমার দোকানে। তারা আমাকে জিজ্ঞেস বললো, 'ভাই আপনি তো ডক্টর! তাহলে আপনিই বুঝবেন।'

 'কী হয়েছে?' 

'জানি না। সামনে একটা অল্প বয়সি মেয়ে পরে আছে। শরীর থেকে অনেক রক্ত বের হচ্ছে। তবে মনে হচ্ছে ধ'র্ষ'ণ মামলা ভাই। মেয়েটার অবস্থা খারাপ ভাই। বাঁচবে কিনা আল্লাহ জানে! আপনি একটু আসেন আমাদের সাথে।'

আমি কোনো মতে দোকানের সাটার নামিয়ে তাড়াতাড়ি করে তাদের সাথে গেলাম। একটু সামনে গিয়েই দেখলাম চার পাঁচজন মানুষ একসাথে জটলা পাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাদেরকে সরিয়ে ভিতরে ঢুকে দেখলাম সেই মেয়েটা পরে আছে। শরীরের বিভিন্ন অংশে খামছির দাগ। তার শরীরের জামা কাপড়গুলোও ঠিক নেই। একজন বয়স্ক ব্যক্তি একটা গামছা দিলো। সেটা দিয়ে তাকে ভালো ভাবে ঢেকে দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, 

'এই অবস্থা কে করলো?

সবসময়ের মতো মুখে মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে খুব কষ্টে বললো, এ...এ...এখান দিয়েই আসছিলাম তারপর... তারপর... বাদ দেন ভাইয়া। জা...জানেন আমি খুব টেনশনে ছিলাম আপনার টাকাগুলো দিতে পারবো কিনা এজন্য। এই যে আপনার টাকা। 

তারপর রক্তাক্ত হাতে কিছু টাকা বের করে আমার সামনে ধরলো। টাকাগুলোও তার হাতের র'ক্তে লাল হয়ে গেল। সে আবারও বলতে লাগলো, ভাইয়া আমি ছাড়া আমার আম্মুর এই দুনিয়ায় কেউ নেই। আ...আ...আপ... এই কথা বলেই চুপ হয়ে গেল। আর কোনো কথা বলতে পারলো না। আমি নাড়ী চেক করে দেখলাম সে আর নেই। এই দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করে চলে গেছে। সবকিছু এতো তাড়াতাড়ি ঘটে গেল যে, তাকে হসপিটালে নিয়ে যাওয়ার কোনো চান্সই পেলাম না।

তাড়াহুড়ো করে একটা ফুলের মতো প্রাণ চলে গেল এই দুনিয়া থেকে। কিছু জঘন্য পশুদের কারণে একটা ফুল ঝরে গেল এই দুনিয়া নামক বাগান থেকে। আরো একজন বোন ধ'র্ষ'ণে'র শিকার হয়ে কোনো বিচার না পেয়েই দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করে চলে গেল। আরো একজন মায়ের বুক খালি করে দিলো কিছু মানুষ নামক নিকৃষ্ট জীব। এভাবে আর কতো দিন?

লেখক : বি.এম আকাশ

বিভাগ