এ রায়হান চৌধূরী রকি, পঞ্চগড় থেকে: পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার মাড়েয়া ইউনিয়নের করতোয়া নদীর আউলিয়া ঘাটে নৌ-ট্রাজেডির এক বছর পূর্ণ হলেও টেন্ডার প্রক্রিয়াতেই ঝুলে আছে সেই ওয়াই ব্রীজ।
গত বছরের এই দিনে আউলিয়া ঘাটে স্মরণকালের ভয়াবহ নৌ দূর্ঘটনা ঘটে। দূর্ঘটনার পরই উদ্ধার অভিযানে নামে ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দল ও স্থানীয় উদ্ধারকারীরা। একে একে উদ্ধার করা হয় ৭১টি নিথর দেহ। নদীর ওপার একই উপজেলার বড়শশী ইউনিয়নের বোদেশ্বরী মন্দিরে মহালয়ার অনুষ্ঠানে যোগ দিতে শতাধিক যাত্রী নিয়ে একটি নৌকা নদী পার হওয়ার সময় মাঝপথে ডুবে যায়। এ সময় অনেকে সাঁতরে উঠতে পারলেও নিখোঁজ হন নারী-শিশুসহ ৭২ জন পূর্ণার্থী। এখনও নিখোঁজ একজনের সন্ধান মেলেনি। দূর্ঘটনার পর সরকারি-বেসরকারি সহায়তায় নিহতের পরিবারগুলো ঘুরে দাড়ানোর চেষ্টা করলেও সেইসব পরিবারগুলো আজো খুজেঁ ফিরছে স্বজন হারানো স্মৃতি। দূর্ঘটনার পরই জেলা প্রশাসন, পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস তিনটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। এর মধ্যে জেলা প্রশাসনের তদন্ত প্রতিবেদনে ওই দূর্ঘটনায় ঘাট ইজারাদারকে দায়ী করে প্রতিবেদন দাখিল করে। তবে তারা পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন প্রকাশ করেনি। এছাড়া ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশের প্রতিবেদনও আলোর মূখ দেখেনি।
এদিকে সেইসময় নৌকাডুবির ঘটনায় জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিহত পরিবারগুলোকে শেষকৃত্যের জন্য নগদ ২০ হাজার টাকা করে এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে নগদ ৫০ হাজার টাকা ও শুকনো খাবারের প্যাকেট দেয়া হয়। এছাড়া ধর্ম মন্ত্রণালয়ের হিন্দু ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টের পক্ষ হতে নিহত ব্যক্তিদের প্রত্যেক পরিবারকে ২৫ হাজার টাকা করে আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হয়।
অন্যদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে নিহত প্রতি পরিবারেরকে ৫০ হাজার টাকা, জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে প্রতি পরিবারকে ৩০ হাজার টাকা, বিএনপি'র পক্ষ থেকে নৌকাডুবিতে মৃত ৬৯ জনের পরিবারকে ১০ হাজার করে টাকা প্রদান করা হয়। ব্যক্তিগত উদ্যোগে জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি নাঈমুজ্জামান মুক্তা আর্থিক সহায়তা করেন। এছাড়া বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে ক্ষতিগ্রস্ত ৯ পরিবারের সদস্যদের মাঝে ১৫ লক্ষ টাকা এবং রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির পক্ষ থেকে ক্ষতিগ্রস্ত প্রতি পরিবারকে ৫ হাজার টাকা করে দেওয়া হয়।
পঞ্চগড়ে করতোয়া নদীতে নৌকাডুবিত ৭১ জনের মৃত্যু ও একজন নিখোঁজের ঘটনার ছয় মাস পর দুইজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গত ১৪ মার্চ মামলার আসামি ঘাট ইজারাদার আব্দুল জব্বার ও ঘাটের মাঝি (নৌকা চালক) বাচ্চু মিয়াকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পরে আদালতের মাধ্যমে তাদের কারাগারে পাঠানো হয়।
গত বছরের ২৫ সেপ্টেম্বরের এ নৌকাডুবির ঘটনা ঘটে। গত ২৭ ফেব্রুয়ারি নৌপরিবহন অধিদফতরের মুখ্য পরিদর্শক শফিকুর রহমান বাদী হয়ে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে এ ঘটনায় মামলা করেন।
মামলার আসামিরা হলেন- ঘাট ইজারাদার আব্দুল জব্বার, মাঝি বাচ্চু মিয়া ও মাঝি রবিউল ইসলাম। মামলা সূত্রে জানা গেছে, আসামিদের বিরুদ্ধে নৌযানের আকার ও আকৃতি বিবেচনায় ধারণক্ষমতার বেশি যাত্রী বহন, নৌযানের বৈধ, চালক রেজিস্ট্রেশন ও সার্ভে সনদ না থাকা, নৌযানে সনদধারী মাস্টার, সুকানি ও গ্রিজার না রেখে নৌযান চালানো, ইজারা চুক্তি মোতাবেক নিরাপত্তা সামগ্রী ও জীবন রক্ষাকারী সরঞ্জাম না রাখা এবং চালকের অদক্ষতাকে দায়ী করে এ মামলা করা হয়।
জেলা পরিষদ নিলাম ডাকে প্রতিবছর এ ঘাট ইজারা দিয়ে থাকেন। পরে অবশ্য জেলা পরিষদ এই ইজারা বাতিল করে।
নৌকাডুবিতে বেঁচে ফেরা দিপু সেদিনের বিভীষিকাময় স্মৃতির কথা বলেন, "আমরা মহালয়া অনুষ্ঠানে যাচ্ছিলাম। নদীর মাঝখানে যাওয়ার পর হঠাৎ করে নৌকা দুলতে থাকে। তারপর আমি নিচে পড়ে যাই। কিছুক্ষণ আমি কিছুই বুঝতে পারিনি। তারপর সাঁতার কাটলাম। আমি আমার নিজ হাতে তিনটা মরদেহ উদ্ধার করেছি। আরও কয়েকজনকে বাঁচিয়েছি।"
মর্মান্তিক এই নৌকাডুবিতে অনেক শিশু তার বাবা-মাকে হারিয়েছে, স্ত্রী হারিয়েছেন স্বামীকে, অনেকে স্ত্রী-সন্তান হারিয়ে দিশেহারা। আবার অনেকে পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে যেন নির্বাক হয়ে গেছে।
বোদা উপজেলার মাড়েয়া বামনহাট ইউনিয়নের আরাজী শিকারপুর বটতলী গ্রামের বাসিন্দা হেমন্ত রায় বলেন,"আমাদের কোনও উৎসব নেই, আনন্দ নেই। আমাদের জীবনে কোনোদিন মনে হয় উৎসব ফিরেও আসবে না। স্ত্রী, মেয়ে, ভাইয়ের স্ত্রী, নাতনিদের হারিয়ে আমাদের দুটি পরিবার নিঃস্ব হয়ে গেছে। "
মাড়েয়া বটতলী এলাকার ষাটোর্ধ্ব ননী বালা বলেন, "মহালয়ার পূজা দিতে গিয়ে আমার উপার্জনক্ষম একমাত্র ছেলে জগদিশ চন্দ্রকে হারিয়েছি।
জগদিশের দুই অবুঝ শিশু স্বন্দীপ আর প্রিয়াংকা অনাথ হয়েছে। নৌকাডুবিতে জগদিশের সঙ্গে থাকা ভাতিজা সেন্টু চন্দ্রও (২৬) মারা গেছে। তাদের কথা মনে হলেই নিজেকে সামলাতে পারি না। অনেক কষ্ট বুকে চেপে অনাথ ছোট দুই বাচ্চাকে নিয়ে বেঁচে আছি।"
পঞ্চগড়ের বোদায় করতোয়া নদীর আউলিয়া ঘাটে একটি সেতু নির্মাণের জন্য জনপ্রতিনিধিসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মকর্তাদের কাছে বহু বছর আগে থেকেই ধরনা দিয়ে আসছিল এলাকাবাসী। যার প্রেক্ষিতে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) কর্মকর্তারা সেখানে গিয়ে কয়েক দফায় মাপজোখও করে আসেন। কিন্তু বহুকাঙ্খিত সেই সেতুর গত এক বছরেও বাস্তবে নির্মাণ কাজ হয়নি।
করতোয়া নদী বোদা বড়শশী ও কাজলদীঘি কালিয়াগঞ্জ ইউনিয়নকে উপজেলা সদর থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে। এখানে ব্রিজ নির্মাণের দাবি দীর্ঘদিনের। ব্রিজটি নির্মিত হলে বোদা ও দেবীগঞ্জের মানুষর যাতায়াত সহজ হয়ে যাবে। ব্রিজের অভাবে রোগীবাহী অ্যাম্বুলেন্স, কৃষকদের উৎপাদিত পণ্যসহ যানবাহনগুলোকে জেলা শহরের ওপর দিয়ে প্রায় ৫০ কিলোমিটার পথ ঘুরে যাতায়াত করতে হয়।
এবিষয়ে বদেশ্বরী মন্দির কমিটির প্রচার ও প্রকাশনা বিষয়ক সম্পাদক হরিশ চন্দ্র রায় বলেন, " এবছর আমরা কোন ধরনের প্রচার প্রসার করবো না। কোন পোস্টার, চিঠিপত্র ছাপানো হবে না। আয়োজন হবে সীমিত। তবে সেচ্ছায় পূণ্যার্থীরা যদি আসেন তবে তাদের পূজা আর্চনার সুযোগ দেয়া হবে এবং প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা ও সহযোগিতার ব্যবস্থা করা হবে। যতদিন পর্যন্ত সেতু নির্মাণ না হবে ততদিন পর্যন্ত সীমিত আকারে মহালয়া উৎযাপন করা হবে।"
এদিকে গতবছরের ভয়াবহ নৌকাডুবির কথা মাথায় রেখে ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছে জেলা প্রশাসন। পঞ্চগড় জেলা প্রশাসক জহুরুল ইসলাম জানান, "আমরা ঘাট ইজারাদার এবং মন্দির কমিটির সাথে কথা বলেছি। নিরাপদে যাতে মানুষ নদী পার হতে পারে সেদিকে লক্ষ্য রাখা হবে। এছাড়া নৌকাডুবির মতো ঘটনা যাতে পুনরায় না ঘটে সে বিষয়ে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে
নৌকাডুবির ঘটনার পর গত বছরের ২৩ অক্টোবর স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী তাজুল ইসলাম পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার আউলিয়ার ঘাটে করতোয়া নদীর ওপর সেতু নির্মাণের স্থান পরিদর্শন শেষে মাড়েয়া বামনহাট ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ আয়োজিত সমাবেশে এখানে শিগগিরই সেতু নির্মাণ কাজ শুরু হবে বলে ঘোষণা দেন। অনুষ্ঠানে স্থানীয় সংসদ সদস্য রেলপথ মন্ত্রী অ্যাডভোকেট মো. নূরুল ইসলাম সুজনও উপস্থিত ছিলেন। ঘোষণা অনুযায়ী এলজিইডির তত্ত্বাবধানে ১১৬ কোটি টাকা ব্যয়ে ৮৯১ মিটার দৈর্ঘ্য এবং ৭.৩২ মিটার প্রস্থ ইংরেজি ওয়াই আকৃতির ব্রিজ নির্মাণ করার কথা। কিন্তু দীর্ঘদিনেও সেতু নির্মাণের কাজ শুরু হয়নি।
পঞ্চগড় স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মাহমুদ হাসান জানান, দরপত্র অনুমোদন হলেও নির্মাণ কাজ শুরু হবে। আশা করছি খুব শিগগিরই দরপত্রের অনুমোদন হবে।