বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ১৭ এপ্রিল এক অবিশ্বরণীয় দিন। ১৯৭১ সালের এই দিনে তৎকালীন কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর মহকুমার বৈদ্যনাথ তলার আমবাগানে স্বাধীন বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামানুুসারে বৈদ্যনাথ তলার নাম করা হয় মুজিবনগর। আর সরকারের নাম করা হয় মুজিবনগর সরকার।
পাকিস্তানিদের হামলা এবং বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তারের পর তাজউদ্দীন আহমদসহ অন্যান্য আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা প্রতিবেশী দেশ ভারতে চলে যান।
সেখানে তারা ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠন করে। এদিনই রাত ১০টায় প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ভাষণ প্রদান করেন। পরদিন ১১ এপ্রিল উক্ত ভাষণ আকাশবাণী কলকাতা বেতার, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র, বিবিসি ও ভয়েস অফ আমেরিকায় প্রচার করা হয়।
উক্ত সরকারের শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন টাঙ্গাইলের আব্দুল মান্নান এবং স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন দিনাজপুরের অধ্যাপক ইউসুফ আলী এমএনএ।
১৭ এপ্রিল বাংলাদেশ সরকারের শপথগ্রহণকারী মন্ত্রিপরিষদে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলাম উপ-রাষ্ট্রপতি, তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রী, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, খন্দকার মোস্তাক আহমদ, এএইচএম কামরুজ্জামান, কর্নেল এমএজি ওসমানী প্রধান সেনাপতি।
এ সরকারের নেতৃত্বেই মহান মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়। তৎকালীন সময়ে আমাদের দেশে অনেক স্থানে বিহারি রিফুজিরা ছিলো সংখ্যাগরিষ্ঠ। ওইসব স্থানে বাঙালিদের ওপর অত্যাচার নির্যাতন শুরু করে ১৯৭১ সালের প্রথম দিক থেকেই। এক্ষেত্রে পাকিস্থানি সেনা বাহিনী সর্বপ্রকার সাহায্য-সহযোগিতা করে। দিন বাড়ার সাথে সাথে বিহারিদের নির্মমতা বাড়তে থাকে। এসময় আমাদের দিনাজপুরেও বিহারীদের অত্যাচার নির্যাতন ভয়াবহ আকার ধারণ করে। আমাদের উত্তর বাংলার সৈয়দপুর ও পার্বতীপুরে প্রচুর বিহারী রিফুজি ছিলো।
দিনাজপুর শহরেও বিহারীদের সংখ্যা অনেক ছিলো। সেই সাথে বাংলার কিছু বেঈমান তাদের সাথে যোগ দেয় বাঙালিদের ওপর আক্রমণে। যার জন্য প্রথম দিকে বিহারীরা একতরফাভাবে হত্যা, মারপিট ও লুটতরাজ করতে থাকে। তাদের এই অপকর্মের কারণে আমরা বাঙালিরাও সংগঠিত হয়ে প্রতিরোধ গড়ি। এই প্রতিরোধ কর্মে তৎকালীন ইপিআর বাহিনীতে কর্মরত বাঙালি সন্তানরা আমাদের সাথে যোগাযোগ করে এবং সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়। এক পর্যায়ে আমাদের দিনাজপুরের সংগ্রামী জনতা এবং ইপিআর বাহিনী সংগঠিত হয়ে পাকিস্থানীদের প্রতিরোধ করে।
বিহারীসহ পাকিস্থানি ইপিআর ও পুলিশ বাহিনীকে দিনাজপুর থেকে বিতাড়িত করে। ফলে দিনাজপুর শহর পরিচালিত হয় আমাদের সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটির নেতৃত্বে।
৩১ মার্চ দিনাজপুর শহরে একটি সর্বদলীয় মিটিং হয়। মিটিংয়ের সিদ্ধান্ত মোতাবেক অধ্যাপক ইউসুফ আলী এমএনএ, গোলাম রহমান, এ এম আই জেড ইউসুফ, গুরুদাস তালুকদার প্রমুখ নেতৃবৃন্দের নামে একটি প্রচারপত্র প্রকাশিত হয় ১ এপ্রিল।
উক্ত প্রচারপত্রে বেশ কয়েকটি সিদ্ধান্ত প্রচারিত হয়। তাতে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠনের দাবি করা হয় এবং সর্বস্তরের মানুষের কাছে মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের জন্য আবেদন করা হয়। প্রচার পত্রটি আমরা সর্ব সাধারণের কাছে বিতরণ করি। এই প্রচার পত্রটি কলকাতায় কালন্তর পত্রিকায় ছাপানো হয়। এতে আমাদের দিনাজপুরবাসীর সংগ্রামী কার্যক্রম বিশ্ববাসীর নজরে আসে।
পাকিস্থাানিদের বিতাড়িত করে দিনাজপুর শহর আমাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসি। প্রসাশনিক কাজকর্ম সহ সবই পরিচালনা করতাম সংগ্রাম পরিষদের নেতা কর্মীরা। এরপর কয়েকদিনের জন্য কাঞ্চন ঘাট থেকে ২ মাইল পশ্চিমে ভবানিপুরে আফতাবউদ্দীন সরকারের বাড়িতে জেলা প্রশাসনের সদর দপ্তর স্থানান্তর করা হয়। জেলা প্রশাসন কর্মকর্তারা সরকারের কর্মকান্ড পরিচালনা ও নির্দেশনামা জারি করতে থাকে।
এদিকে পাঁক হানাদার বাহিনী এপ্রিল মাসের শুরুতে ত্রিমুখী আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণে আমাদের ইপিআর বাহিনী এবং বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিকরা টিকতে পারেননি। এক পর্যায়ে রণভঙ্গ দিয়ে সরে যায়। এ সময় আমরাও বাধ্য হয়ে শহর থেকে সরে পড়ি এবং আমাদের অনেকেই মারাত্মকভাবে মনোবল হারিয়ে ফেলে। এদিকে পাক সেনারা সৈয়দপুর, দিনাজপুর ও পার্বতীপুরে শক্তিশালী ঘাটি করে বসে এবং বাঙালিদের ওপর ভয়াবহ অত্যাচার নির্যাতন শুরু করে। তারা হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাত চালায়।
সৈয়দপুরে প্রকৌশলী ফজলুর রহমানকে স্ত্রী ও তিন পুত্রসহ একই পরিবারের ৫ জনকে নির্মমভাবে হত্যা করে। ফজলুর রহমানের স্ত্রী হোসনে আকতারকে বেয়নেট চার্জ করে পাকিস্থানি নরপশুরা মাটিতে জীবন্ত পুতে ফেলে। ঘাতকরা চিরিরবন্দরে মাহতাব বেগকে হত্যা করে তার দেহ থেকে মাথা ছিন্ন করে সেই মাথা নিয়ে উল্লাস করে।
দিনাজপুর শহরেও প্রখ্যাত সঙ্গীত শিল্পী সতীস চন্দ্র সরকারকে প্রথমে দুই চোখ উপড়ে ফেলে। তারপর নির্যাতন করে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে। হত্যা করে ব্যাংক কর্মকর্তা সজিরুদ্দীন, অধ্যাপক ওয়াহিদুর রহমান, প্রকৌশলী ওবায়দুল হক,ডা. এম এ জব্বার, ইসমাঈল হোসেন পল্টু, অধ্যাপক সুমঙ্গল কুন্ডু, হাবিবুর রহমান এডভোকেট, ছাত্র নেতা আসাদুল হক, শাহনেওয়াজ, অধ্যাপক সোলায়মান, আব্দুস সালাম, জহুরুদ্দীন মোক্তার, মো. আমীর আলী সহ অসংখ্য মানুষকে। এই কাজে তাদের সহযোগিতা করে বাঙালি জামাত মুসলিম লীগের নেতা কর্মীরা।
এতে আমাদের নেতা কর্মীদের মধ্য কিছুটা ভীতি ও হতাশা সৃষ্টি হয়। অনেকেই মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়ে।
তবে অধিকাংশ নেতা কর্মী আপোষহীন মনোভাব নিয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য জনমত গঠনের চেষ্টা চালিয়ে যায়। কিন্তু এই সময়ে এমন কিছু সংবাদ বিভিন্নভাবে পাই যা মনকে উৎসাহিত করে, অনুপ্রাণিত করে। যার ফলে আরো সাহসী হই। এই সময়ে এপ্রিল মাসের ১১ তারিখে একটি সংবাদ পাই যে, স্বাধীনতার জন্য একটি সরকার গঠিত হয়েছে।
আরো সংবাদ পাই, উক্ত সরকারের রাষ্ট্রপতি করা হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে এবং উপ-রাষ্ট্রপতি করা হয়েছে সৈয়দ নজারুল ইসলামকে এবং প্রধানমন্ত্রী করা হয়েছে তাজউদ্দীন আহমদকে। এসব সংবাদ আমাদের মনে সাহস এবং শক্তি যোগাতে থাকে। আমরা পুরোদমে মুক্তিযুদ্ধের জন্য সংগঠিত এবং প্রস্তুুত নিতে থাকি। এসময়ে এপ্রিল মাসের ১৭ তারিখে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে জানতে পারি আমাদের সরকারের শপথ গ্রহণের কথা।
শপথের সংবাদ পাওয়ার পর আমাদের মধ্যে আনন্দের ঢেউ জাগে। এতে আত্মবিশ্বাসী হই যে আমাদের বিজয় অনিবার্য। আমরা আরো সংবাদ পাই, উক্ত অনুষ্ঠানে স্বাধীনতা ঘোষণা পাঠ করেন দিনাজপুরের নেতা অধ্যাপক ইউসুফ আলী এমএনএ।
সরকার গঠনের সংবাদ এবং পাকিস্থানীদের অত্যাচার নির্যাতনে ক্ষোভে প্রতিশোধ স্পৃহায় মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য সহকর্মী ও বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে মাতৃভূমি ত্যাগ করে প্রতিবেশী দেশ ভারতে যাই। সেখানে গিয়ে সাত নম্বর সেক্টরে প্রশিক্ষণ নিয়ে স্বদেশে ফিরে আসি এবং পাক হানাদারদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধে লিপ্ত হই। বেশ কয়েকটি যুদ্ধে পাকিস্থানীদের বিরুদ্ধে সফলতা অর্জন করি। যুদ্ধের ময়দানে ৩১ শে জুলাই দিনাজপুর জেলার ফুলবাড়ি উপজেলার ভেড়াম নামক গ্রামে এক ভয়াবহ যুদ্ধে আমি মারাত্মকভাবে আহত হই এবং আমার সহযোদ্ধা বীর মুক্তিযোদ্ধা মোজাফফার শহীদ হন।
পাকিস্থানীদের বিরুদ্ধে ৯ মাসের সশস্ত্র যুদ্ধের পর ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আমরা বিজয় অর্জন করি।
মুজিবনগর সরকারের শপথ অনুষ্ঠানের ৫২ বছর পূর্তিতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মহান আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে বিজয় অর্জন করতে হবে।
এ জন্য বঙ্গবন্ধুর আদশের সৈনিকদের জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার বিনীতভাবে অনুরোধ জানাই। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।
লেখক :-
অধ্যাপক ডা. এম আমজাদ হোসেন
স্বাধীনতা পদক প্রাপ্ত-২০২১ (সমাজসেবা ও জনসেবায়)
চিফ কনসালটেন্ট ও বিভাগীয় প্রধান,
অর্থোপেডিক, ট্রমা এবং রিপ্লেসমেন্ট সার্জারি বিভাগ
ল্যাব এইড স্পেশালাইজড হাসপাতাল।