Type Here to Get Search Results !

ছিটের স্বাধীনতা

                                                                                                বেলাল হোসাইন : 
প্রথমে একটা গল্প বলে নিই। গল্পটা হল যতিন বাজারে যাচ্ছিল। যেতে যেতে দেখল রাস্তায় কিছু সংখ্যক পুরুষ-মহিলা ডালি-চাঙ্গারী নিয়ে মাটি ফেলছি। মনে কৌতুহল জাগল-এতদিন ছিটের রাস্তা-ঘাটের বেহাল দশায় কেউ চোখ তুলে তাকাই নি, আর কার এত দরদ হল যে, ভাংগা ঘরে আতশ বাজি করার। যারা কাজ করছিল তাদের একজনকে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলাম ইউনিয়ন চেয়ারম্যান এবং আওয়ামীলীগের ইউনিয়ন সভাপতি সেক্রেটারীগন ছিটের মানুষদের বেহাল অবস্থা দেখে দয়া কের রাস্তার কাজটুকু করে দিয়েছে। বাজারে গিয়ে মতিনের সাথে দেখা।
যতিনকে দেখে মতিন মশকরা করে বলল“কিরে যতিন তুই আবার দিনের বেলা বাজারে এলি ক্যান? রাতের বেলা এলে অনেক মানুষ তোর আলোয় আসতে পারত”।
মতিনের শুনে যতিন বলল-“আমি তো আর ভাই তোর চেয়ে বেশি মূল্যবান নই যে, দিনের বেলা ছাড়া রাতের বেলা আসতে পারব না। তুই তো আবার মহামূল্যবান মতি”। বলেই দুজনে হাসতে লাগল। হাসি থামিয়ে যতিন বলল-কি বাজার করলি? “আর বলিস না! সারাদিন কাজ করে পাইছি এমশত কুড়ি টাকা।
ভাবলাম, বোতলগঞ্জ বাজারে কন্ট্রোনের চাল দিচ্ছে চব্বিশ টাকা দরে, নিয়ে আসি। বাজারে এখন কিনতে গেলে পঁয়ত্রিশ টাকা দরে কিনতে হবে। কিন্তু এসে দেখি দুজন লোকের মধ্যে একজন সাদা কাগজে কিছু মহিলা-পুরুষের নাম লিখছে সিরিয়াল করে। আর একজন টিপ সহি দিচ্ছে চারদিকে চোরের মত তাকিয়ে। বুঝলাম, দুই নম্বরি না হলেও তিন নম্বার হচ্ছে যে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না”।
মতিনের কথা শুনে যতিন হেসে বলল-“বাংলাদেশের বাজারে এসে সুবিধা গ্রহন করিস আর সরকারের গীবত গাস। শালা সরকারী আমলারা শুনলে তোর বারোটা না বাজালেও একটা বাজতে সময় লাগবে না। ভাগ্যিস লিবিয়ার মত বাংলাদেশ সরকার নয়।
জানিস তো লিবিয়ার প্রতি দশজন নাগরীকের মধ্যে একজন সরকারী গুপ্তচর। বাংলাদেশেতো সেটা নেই”। যতিনের কথা শনে মতিন বলল- “আরে তাই তো। চিলাহাটিতে নাকি স্থলবন্দর হবে। এজন্য রেল ষ্টেশনের জায়গা সম্প্রসারন করছে। ষ্টেশনের পুকুর গুলো ভরাট করার জন্য ছিট থেকে মাটি আসছে। এতে নাকি আজকে বিডিআর বাধা দিয়েছে। কারণ ছিট ভূমি বিডিআর দের নিয়ন্ত্রনে আছে। পরে নাকি মীমাংসা হয়েছে শুনলাম। মীমাংসা না হলে ছিটের কোন বাসিন্দাকেই বাংলাদেশের মাটিতে পা দিতে দিত না-এটা অনেকেই বলাবলি করছে। কেন ভাই আমরা ওদের সংগে লাগতে যাই। তুই-ই-বল। আমরা হইলাম যাযাবর। আমাদের তো নির্দিষ্ট কোন ঠিকানা নেই। আমরা কোন দেশের নাগরিক কেউ-ই জানি না। 
আমরা যে কৃষি করছি, তার জন্য সার-বীজ, কীটনাশক সবইতো বাংলাদেশের বাজার থেকে কিনছি। তাও আবার চড়া দাম দিয়ে। বাংলাদেশী নাগরিক যারা, তারা সার কিনছে তিনাদের কাছ থেকে সরকারের দেওয়া নেয্য মূল্যে। কিন্তু আমাদের তো সেটা হচ্ছে না। তারা নাগরিক সুবিধা পাচ্ছে। আমরা পাচ্ছিনা।
আমাদের ছেলে-মেয়েরা বিদ্যালয়ে যাচ্ছে ঠিকই। কিন্তু সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে না শুধু বই ছাড়া। শিক্ষকদের কাছে শুনেছি বইও নাকি বাংলাদেশী ছাত্র-ছাত্রীদের নামে বরাদ্দ হয়ে আকে। সেই বই-ই ছিটের ছেলে-মেয়েদেরকে দেওয়া হয়। নাগরিকের সবচেয়ে বড় চাওয়া হচ্ছে ভোটাধিকার। কিন্তু সেই ভোটাধিকার আমাদের নেই।
মোট কথা, আমরা স্বাধীন নই। মতিনের কথা শুনে যতিন বলল “বাজার করা হয়েছে। এখন চল চলে যাই। এতসব চিন্তা করতে হবে না। আমি আর তুই ছিটের স্বাধীনতাও আনতে পারব না। আবার আন্দোলনও জড়ালো করতে পারব না।”
প্রসঙ্গত, তিনটি ছিট কোট ভাজনী, খারিজব ভাজনী, আর ফাজল দিঘী। এই তিনটি ছিটে প্রায় পঁয়তাল্লিশ হাজার বাসিন্দা। তারা বাংলাদেশী যে কোন নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত। এখানে নেই কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, নেই কোন উন্নয়ন প্রকল্প, নেই কোন দাতব্য প্রতিষ্ঠান। এনজিও কর্মীরাও ঋণ প্রদান করতে ভয়পায়। ভয়পান সমাজ কর্মীরাও। কারণ সমাজের মধ্যে কোন শৃংখলার অবনতি হলে দায় নিতে চান না কেউ।
শুধু ছিট বাসিন্দাদের দ্বারা নির্বাচিত একজন ব্যক্তিকে চেয়ারম্যান করে নানা সালিমী কাজ সম্পাদন করা হয়। কিন্তু সেই ব্যক্তিটিও বাংলাদেশী বিত্তবান লোক। সমস্যার সমাধান করতে ছিট বাসিন্দারা হেস্থনেস্থ হলেও কেউ এগিয়ে আসেন না। অনেক সময় ছিটে বসবাস করাও হুমকি হয়ে দাঁড়ায় ছিট বাসিন্দাদের মোট কথা, তারা জানে না কোন দেশের নাগরিক। তারা আশা করছে- “১৯৭৪ সালে মুজিব-ইন্দিরাচুক্তি’র বাস্তবায়ন হলেই স্বাধীনতার মূখ দেখার”
 
লেখক : সাংবাদিক
বিভাগ